দাঁতে দাঁত চেপে অসহ্য প্রসববেদনা সহ্য করেন একজন মা, সুস্থ সুন্দর সন্তানের প্রত্যাশায়। বাংলাদেশ এখন এমন এক প্রসববেদনার কাল অতিক্রম করছে। দেশ সরকারবিহীন ছিল তিন দিন। এরপরই আসে অন্তর্বর্তী সরকার। এই অন্তর্বর্তী সরকার কি সেই ধাত্রী, যারা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা আর অস্বস্তি নিয়ে তুল্য নয় এমন এক সময় পার করে বাংলাদেশকে নিয়ে যাবে স্বাভাবিকতায়?

দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা একজন প্রধানমন্ত্রীকে যেভাবে ক্ষমতাচ্যুত করল, তা অভূতপূর্ব। আওয়ামী সরকারের অব্যবহিত পর বেশ কিছু পদক্ষেপ তরুণ আন্দোলনকারীদের চাওয়া অনুযায়ী হচ্ছে।

বলা যায়, সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে ক্ষমতা এখন তরুণ বাংলাদেশিদের হাতে। তাঁদের এখন অবশ্যই প্রধান করণীয় হবে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাঁদের হাতে যে ক্ষমতা এসেছে, তার মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য দূর করার মতো কাজে মনোযোগী হওয়া।

দেশজ বাস্তবতা ও জনচাহিদার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অন্তর্বর্তী সরকার প্রয়োজন। নারীদের প্রতিনিধি যেমন থাকা দরকার, তেমনি স্বতন্ত্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধি যেন থাকে, তা–ও বিবেচনা করা উচিত। এই দুটি বিষয়ের সমন্বয় করা হয়েছে প্রয়োজন অনুযায়ী।

এর আগে ২০০৭ সালের ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার সফল না হওয়ার একটি অন্যতম কারণ ছিল তাঁর সহ–উপদেষ্টাদের কর্মপরিকল্পনার অভাব। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যদের গণমাধ্যমে বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে নিজ নিজ অধিক্ষেত্রের বাইরে অন্য বিষয় নিয়ে সিদ্ধান্তমূলক মন্তব্য জটিলতা তৈরি করতে পারে। শপথ নেওয়ার পর এবং পরিষদের প্রথম বৈঠক শেষে এই অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ–সংক্রান্ত জিজ্ঞাসার উত্তরে অসহিষ্ণু হতে দেখা গেছে।

আওয়ামী সরকার বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে সংবেদী যোগাযোগ ব্যর্থতার কারণে প্রায় পুরো জনসমষ্টি তাদের বিপক্ষে দাঁড়ায়। যোগাযোগ ব্যর্থতায় কী ঘটতে পারে তার ফল তো এই উপদেষ্টা পরিষদ স্বয়ং।

গত শাসন আমলে রাষ্ট্র ও জনগণ ছিল মেরুপ্রতিম দূরত্বে। রাষ্ট্র ও জনতার মধ্যে অসেতুসম্ভব দূরত্ব এই বিপ্লবের মহা অনুঘটক।

রাজা যায় রাজা আসে, কিন্তু কিছু বিষয় বদল হয় না এই বাংলার মানুষের। একাত্তরের স্বাধীনতার পর প্রথমবার সে সুযোগ এসেছিল। পরে নব্বইয়ের এরশাদের পতনের পর, ২০০৭ সালের সুযোগও আমরা হারিয়েছি। আরও একটি সুযোগ আমরা পেয়েছি। কিন্তু কোনো অবিমৃশ্যকারিতা কিংবা রাজনৈতিক হঠকারিতার কারণে এই দফায় সে সুযোগ যেন নষ্ট না হয়।

জাতির জীবনপরিক্রমায় রাষ্ট্র গঠনের বা মেরামতের সুযোগ খুব ঘন ঘন আসে না। আমাদের সামনে আরেকটি সুযোগ এসেছে। রাষ্ট্রের গাঠনিক প্রক্রিয়াকে মাথায় রেখে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী টমাস গ্রিনের একটি উক্তি, যা রাষ্ট্র হয়ে ওঠার সময়ে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘শক্তি নয়, ইচ্ছাই রাষ্ট্রের ভিত্তি।’ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একটা স্কুল অব থট বলে, নিজ প্রয়োজনেই মানুষ রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে, মেরামত করে।

অবস্থার উন্নয়ন ও পরিস্থিতির উত্তরণ, তা সে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক যে ক্ষেত্রেই হোক, তা প্রত্যেক সমাজ–রাষ্ট্রের অভিমুখ। রাজনৈতিক উন্নয়ন ধারণাটি নিয়ে তাত্ত্বিক ও দার্শনিক ইয়োশিহিরো ফ্রান্সিস ফুকুইয়ামা তাঁর কয়েক বছর আগে  প্রকাশিত আলোচিত বই ‘অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অর্ডার’-এ (২০১১) আলোচনা করেছেন।

‘অরিজিনস অব পলিটিক্যাল অর্ডার’ বইতে রাজনৈতিক উন্নয়ন বলতে তিনটি বিষয়ের অন্তর্গত স্থিতিশীলতা ও এক ধরনের ভারসাম্য দরকার বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বইতে বলেন, এগুলো হচ্ছে রাষ্ট্রনির্মাণ (স্টেট বিল্ডিং), আইনের শাসনের সুসংহতকরণ (কনসলিডেশন অব রুল অব ল) এবং গণতন্ত্রে উত্তরণ (ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশন)।

Share.
Leave A Reply

Exit mobile version