ফোন চুরি হওয়া মানে এখন আর শুধু একটি ডিভাইস চুরি হওয়া নয়। ফোনের সাথে বেহাত হতে পারে ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ডের মতো সংবেদনশীল নানা তথ্য। আপনার ই-মেইল, সোশ্যাল মিডিয়াসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ সাইটের অ্যাক্সেস চলে যেতে পারে একেবারে অপরিচিত কোনো ব্যক্তির কাছে। আর এই তথ্য ও অ্যাক্সেস যদি পেয়ে যান কোনো হ্যাকার, তাহলে বিপদের আর শেষ নেই। অ্যাক্টিভিশন লক
ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অ্যাপল ২০১৩ সালে আইওএস ৭ অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে আইফোনে নিয়ে আসে ‘অ্যাক্টিভিশন লক’ ফিচার। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে আইপ্যাড, অ্যাপল ওয়াচ ও ম্যাক ডিভাইসে (অ্যাপল সিলিকন সিরিজের চিপ বা টি২ সিকিউরিটি চিপ সমৃদ্ধ) যুক্ত করা হয় এই ফিচারটি।অ্যাপল ডিভাইসের ‘ফাইন্ড মাই’ সিস্টেমের একটি অংশ হলো ‘অ্যাক্টিভিশন লক’। এই ফিচারটি ব্যবহার করে চুরি হওয়া আইফোনটিকে আইক্লাউড সিস্টেম থেকে ‘লক’ করে দেয়া সম্ভব। ফোনটি তখনই আবার সচল হবে যখন এটির আসল মালিক বৈধ আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে ডিভাইসটিকে ‘আনলক’ করবেন। ফলে চুরি হওয়া আইফোনটি কার্যত অকেজো হয়ে পড়বে। উল্লেখ্য, অ্যাপল ডিভাইসে ‘ফাইন্ড মাই’ সিস্টেম সচল (টার্ন অন করা) থাকলে প্রতিবার ডিভাইসটি ব্যবহারের জন্য ‘অ্যাক্টিভিশন লক’ প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে যেতে হয় ব্যবহারকারীকে।‘অ্যাক্টিভিশন লক’ ফিচারটির কল্যাণে আইফোনে অনাকাঙ্ক্ষিত অ্যাক্সেস রোধ করা যায় ঠিকই, কিন্তু চুরি হওয়া আইফোনটির ডিসপ্লে স্ক্রিন, সেন্সর, রিবন, ব্যাটারিসহ বিভিন্ন পার্টস বা কম্পোনেন্টগুলো আলাদা করে বিক্রি করে দেয়া যায়। ফলে চুরি হওয়া আইফোনের বিভিন্ন পার্টস (যন্ত্রাংশ) হরহামেশাই কেনাবেচা হয় রিপেয়ার মার্কেটে বা ব্ল্যাক মার্কেটে। এ সমস্যার সমাধানে এবার অ্যাপল নিয়ে এসেছে নতুন ধরণের অ্যাক্টিভিশন লক। এই ফিচারটি সম্পর্কে অ্যাপলের দাবি যদি সত্যি হয় তাহলে আইফোন চুরির হার শুধু কমে যাবে না, বলতে গেলে প্রায় বন্ধই হয়ে যাবে।
অ্যাপলের আইওএস ১৮-ভিত্তিক নতুন অ্যাক্টিভিশন লক
গত ১৬ সেপ্টেম্বর (সোমবার) আইওএস ১৮ এর পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ (ফাইনাল ভার্সন) রিলিজ করে অ্যাপল। আইওএস অপারেটিং সিস্টেমের এই আপডেটেড ভার্সনে যুক্ত হয়েছে নতুন অ্যাক্টিভিশন লক ফিচারটি। কী এর বিশেষত্ব, চলুন জেনে নেয়া যাক।
আইওএস ১৮ এর নতুন নিরাপত্তা ফিচার হিসেবে ‘অ্যাক্টিভিশন লক’ এখন যুক্ত হয়েছে আইফোনের বিভিন্ন পার্টস বা কম্পোনেন্টেও। অর্থাৎ ডিসপ্লে, ব্যাটারি, ক্যামেরার মতো গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশগুলোকে এখন ফোনটির মালিক বা ব্যবহারকারীর অ্যাপল আইডি’র সাথে যুক্ত (লিঙ্ক) করা হয়েছে। ফলে চুরি হওয়া আইফোনের বিভিন্ন পার্টস বা যন্ত্রাংশ বিক্রি করে মুনাফা লাভ করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। উদ্দেশ্য হলো কালো বাজারে চুরি হওয়া আইফোনের বিভিন্ন কম্পোনেন্টের কেনাবেচাকে নিরুৎসাহিত করা এবং অনুমোদিত চ্যানেলে আইফোন মেরামত করতে ব্যবহারকারীদের উৎসাহিত করা।
আইফোনের সুরক্ষা বৃদ্ধি করাসহ চুরি হওয়া ফোনের বিভিন্ন পার্টসের পুনঃবিক্রি রোধ করতে এবং সর্বোপরি চুরি বন্ধ করতে অ্যাপল প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে। এই লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠানটির দীর্ঘমেয়াদী প্রতিশ্রুতির অংশ হচ্ছে অ্যাক্টিভিশন লকের এই উন্নত সংস্করণ। ডিভাইসের সুরক্ষায় আইওএস-ভিত্তিক এই নিরাপত্তা ফিচারটি ইন্ডাস্ট্রিতে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
অর্থাৎ, একসময় যে ‘অ্যাক্টিভিশন লক’ ফিচারটি কেবলমাত্র ডিভাইসে অযাচিত ও অনঅনুমোদিত অ্যাক্সেস রোধ করতে সক্ষম ছিলো এবার সেটার সুরক্ষা ব্যাপ্তি আইফোনের বিভিন্ন হার্ডওয়্যার কম্পোনেন্ট পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। ফলে চুরি হওয়া আইফোনের ডিসপ্লে, ক্যামেরা ও ব্যাটারির মতো যন্ত্রাংশগুলো এখন আর এতো সহজে রিসেইল বা ব্ল্যাক মার্কেটে বিক্রি করা যাবে না।
কিভাবে কাজ করে নতুন ‘অ্যাক্টিভিশন লক’
লিঙ্কড কম্পোনেন্টস: আইফোন তৈরির সময়ই এর গুরুত্বপূর্ণ পার্টস বা যন্ত্রাংশগুলোকে এখন ডিজিটালি যুক্ত (লিঙ্কড) করা হয় ব্যবহারকারীর অ্যাপল আইডি’র সাথে।
ক্রমাংকন যাচাইকরণ (ক্যালিব্রেশন চেক): মেরামত (রিপেয়ার) করার সময় আইফোন স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করে দেখবে রিপ্লেস করা যন্ত্রাংশটি (কম্পোনেন্টটি) মূল ব্যবহারকারীর অ্যাপল আইডি’র সাথে মেলে কিনা। অর্থাৎ পরিবর্তন করে যে পার্টসটি আইফোনে লাগানো হচ্ছে সেটির আইডি আইফোনের মূল মালিকের অ্যাপল আইডি’র সাথে ম্যাচ করে কিনা।
ডিভাইসের সীমাবদ্ধ কার্যকারিতা: ডিভাইসের আইডি’র সাথে যন্ত্রাংশের আইডি ম্যাচ না করার অর্থ হচ্ছে রিপ্লেস করা যন্ত্রাংশটি অন্য কোনো আইফোনের অংশ, যেটি চুরি হয়ে থাকতে পারে। এক্ষেত্রে উক্ত যন্ত্রাংশ বা কম্পোনেন্টটি ব্যবহার করে সব কাজ করা যাবে না। অর্থাৎ এটি দিয়ে সীমিত কিছু কাজই করা সম্ভব হবে।
আইফোনের চুরি রোধ করতে এবং রিপেয়ার শপের উপর প্রভাব
চুরি হওয়া পার্টস কার্যত মূল্যহীন হয়ে পড়বে: চুরি হওয়া আইফোনের যন্ত্রাংশগুলোর সীমিত কার্যকারীতার জন্য এগুলো বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করা চোরের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়বে।
অনুমোদিত চ্যানেলে মেরামত বা রিপেয়ার করতে ব্যবহারকারীরা উৎসাহিত হবে: নতুন এই অ্যাক্টিভিশন লক অনুমোদিত চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে ডিভাইস রিপেয়ার করতে ব্যবহারকারীদের উৎসাহিত করবে। কেননা অনুমোদিত চ্যানেলে যন্ত্রাংশটি চুরি হওয়া কোনো ডিভাইসের কিনা সেটা যাচাই করা যায়।
চুরি রোধ করবে: আইফোন চুরি করে সেটা থেকে মুনাফা অর্জন যেহেতু আরও কঠিন হয়ে পড়বে ফলে আইফোন চুরি করতেই নিরুৎসাহিত হবে চোর।
নতুন অ্যাক্টিভিশন লক ফিচারটির সম্ভাব্য কিছু চ্যালেঞ্জ
থার্ড-পার্টি রিপেয়ার: থার্ড-পার্টি রিপেয়ার শপগুলো বৈধ পার্টস বা যন্ত্রাংশ খুঁজে পেতে এবং সেগুলো যাচাইয়ের ক্ষেত্রে সমস্যার সম্মুখীন হবে।
ব্যবহারকারীর অসুবিধা: মেরামতের ক্ষেত্রে রিপ্লেস করা একটি যন্ত্রাংশ বা কম্পোনেন্টের মালিকানার প্রমাণ যদি ব্যবহারকারীর কাছে না থাকে তাহলে তাকে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে।
আইফোনের যে মডেলগুলোতে ব্যবহার করা যাবে নতুন এই ফিচার
আইফোন ১২ এবং এর পরবর্তী যেকোনো মডেলে অ্যাক্সেস করা যাবে নতুন এই অ্যাক্টিভিশন লক ফিচারটি। তবে ডিভাইসে অবশ্যই আইওএস ১৮ ইন্সটল করা থাকতে হবে। নতুন এই ফিচারে প্রতিটি কম্পোনেন্টের ইউনিক সিরিয়াল নাম্বার আইফোন ব্যবহারকারীর অ্যাপল অ্যাকাউন্টের সাথে লিঙ্ক করা থাকবে। ফলে চুরি হওয়া আইফোন থেকে প্রাপ্ত যন্ত্রাংশগুলো অনঅনুমোদিত ব্যবহারকারীরা অ্যাক্টিভেট বা ব্যবহার করতে পারবেন না।
নতুন এই ফিচারটির আরেকটি ভালো দিক হলো, মেরামত বা রিপেয়ারের ক্ষেত্রে আইফনে লাগানো নতুন একটি কম্পোনেন্ট বা পার্টস অরিজিনাল কিনা সেটা যাচাই করে নিতে পারবেন ব্যবহারকারী। ফলে নকল এবং অনঅনুমোদিত পার্টস ব্যবহারের ঝুঁকিও বহুলাংশে হ্রাস পাবে।